বুধবার, ০৮ জানুয়ারী ২০২৫, ১২:৫৫ অপরাহ্ন
Reading Time: 4 minutes
নিজস্ব সংবাদদাতা, পাবনাঃ
গত জুলাই-আগষ্ট বিপ্লবের ৪ আগষ্ট দুপুর সাড়ে ১২টায় পাবনায় আওয়ামী সন্ত্রাসী ও তার দোসরদের গুলিতে প্রান হারান আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে থাকা জাহেদুল ইসলাম ও মাহবুব হোসেন নিলয় নামের ২ ছাত্র। গুলি বর্ষনে আতংকিত হয়ে ভয়ে মারা যান এক পথচারী। গুলিবিদ্ধ হয়ে আহত হন অসংখ্য ছাত্র-জনতা। এ ঘটনায় গত ১১ আগষ্ট গুলিতে নিহত শহীদ জাহিদুল ইসলামের বাবা মো: দুলাল উদ্দিন মাষ্টার বাদী হয়ে পাবনা সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সাংগাঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ খান চেয়ারম্যানকে প্রধান আসামী করে সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্যসহ আওয়ামীলীগের ১০৩ জন নেতা-কর্মীর নাম উল্ল্যেখসহ অজ্ঞাতনামা আসামী করে পাবনা সদর থানায় একটি হত্যা মামলা দায়ের করেন। মামলা নং ০৫, তাং ১১-০৮-২০২৪ইং। মামলা দায়ের করার দীর্ঘ ৫ মাস অতিবাহিত হলেও প্রধান আসামীসহ গুরুত্বপুর্ন কোন আসামীকে গ্রেফতার করতে পারেনি আইনশৃংখলা রক্ষাকারী বাহিনী। মামলার গুরুত্বপুর্ন আসামী জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আব্দুর রহিম পাকন ইতিমধ্যে বিমানবন্দর দিয়ে ভিয়েনার উদ্দেশ্যে দেশ ত্যাগ করেন। অন্যতম আসামী জেলা আওয়ামীলীগের সাধারন সম্পাদক ও সদর আসনের সাবেক সংসদ সদস্য গোলাম ফারুক প্রিন্সেরও দেশত্যাগের গুঞ্জন রয়েছে। সদর আসনের এমপি বর্তমানে অস্ট্রেলিয়ায় অবস্থানের কথা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হয়েছে। জেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি রেজাউল রহিম লাল, যুগ্ন সম্পাদক সাবেক পাবনা পৌর মেয়র কামরুল হাসান মিন্টু, সাবেক প্রচার সম্পাদক কামিল হোসেন, সাবেক সদর উপজেলার চেয়ারম্যান আলহাজ¦ মোশারোফ হোসেন, সাবেক পৌর মেয়র শরিফ উদ্দিন প্রধান, জেরা যুবলীগের সদস্য সচিব শিবলি সাদিক, যুবলীগ নেতা জেলা পরিষদের ভাইস চেয়ারম্যান নজরুল ইসলাম সোহেল, দোগাছি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আলী হাসান, জেলা যুবলীগের সদস্য একাধিক হত্যাসহ ২ ডজন মামলার আসামী লক বাবু, এমপি প্রিন্সের পিএস রকিসহ গুরুত্বপুর্ন আসামীরা ধরা ছোয়ার বাইরে রয়েছেন। এদিকে সরাসরি হত্যাকান্ডে জড়িত একাধিক আওয়ামীলীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগ, স্বেচ্ছাসেবকলীগের নেতা-কর্মী ও জনপ্রতিনিধিরা পাবনা শহরের আশে পাশে অবস্থান করলেও পুলিশ তাদেরকে গ্রেফতার করছে না, অভিযোগ করেছেন নিহত-আহতদের স্বজন ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতা। আসামী গ্রেফতার করতে না পারায় নিহতদের পরিবার ও আন্দোলনে সম্মুখ সারিতে থাকা নেতৃবৃন্দ ভয়ে ও আতংকে দিনযাপন করছেন। এদিকে শহীদ জাহেদুল ইসলাম হত্যা মামলা বাদী দুলাল উদ্দিন মাষ্টারকে মামলা তুলে নিতে প্রলোভন ও ভয়ভীতি দেখানোর অভিযোগ করেছেন তিনি। নিহত ও আহতদের পরিবারের সাথে প্রশাসন বা আইন শৃংখলারক্ষাকারী বাহিনী যোগাযোগ না করায় নিরাপত্তাহীনতার কথা জানান শহীদ জাহিদুল ইসলামের ভাই নাহিদুল ইসলাম ও তার বাবা দুলাল উদ্দিন মাষ্টার। নিহত জাহিদুলের পিতা বলেন, ছেলে হত্যার বিচার নিয়ে তিনি অনিশ্চয়তায় রয়েছেন। নিহত জাহিদুলের মা মোছাঃ আপিয়া খাতুন ছেলে হত্যাকারীদের দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি দাবি করেন। নাহিদুল ইসলাম বলেন, তার ভাই হত্যার বিচার না পেলে তার পরিবার এই জাতিকে ক্ষমা করবে না।
এ দিকে জেলা যুবলীগের আহবায়ক আলী মর্তুজা সনি বিশ^াসের বাড়ি সদর উপজেলার আরিফপুরের প্রভাবশালী বিশ^াস পরিবারের সন্তান হওয়ায় এবং তার নামে ৫ আগষ্ট পরবর্তি কোন মামলা না হওয়ায়, শহীদ মাহাবুব হোসেন নিলয়ের পরিবার আতংকে রয়েছেন। সনি বিশ^াসের বাড়ি ও শহীদ নিলয়ের বাড়ি একই এলাকার হওয়ায় তার বাবা ভয়ে ছেলে হত্যার মামলা দায়ের করেনি। শহীদ মাহাবুব হোসেন নিলয়ের বাবা আবুল কালাম আজাদ বলেন, ঝামেলা এড়াতে ও নিরাপদ জীবন যাপন করতে তিনি ছেলে হত্যার মামলা দায়ের করেননি। তিনি ছেলে হত্যার বিচার দেশবাসির কাছে ছেড়ে দেন। নিলয়ের মা মোছাঃ দিল আফরোজা আক্ষেপ করে বলেন, সাঈদ তো আগেই ৫০টা খুন করেছে, তার বচার হয়নি। ওইসব হত্যাকান্ডের বিচার হলে আজ আমার ছেলেকে হারাতে হতো না। তিনি আরো বলেন, খুনির বিচার হবে না। খুনিরা প্রকাশ্যে বেড়ালেও পুলিশ তাদের গ্রেফতার করছে না। শহীদ মাহাবুব হোসেন নিলয়ের ভাই মেহেদী হাসান মিলন আক্ষেপ করে বলেন, গত ৫মাস হতে চলল কোন আসামীকে গ্রেফতার করতে পারেনি পুলিশ। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, যেখানে আসামী ধরছে না পুলিশ, সেখানে আমার ভাই হত্যার বিচার আশা করি কিভাবে। হত্যাকান্ডের প্রধান আসামী আবু সাঈদ চেয়ারম্যান, সনি বিশ^াসের আত্মিয় হওয়ার কারনে মাহবুব হোসেন নিলয়ের পরিবার আতংকে রয়েছেন। তারা সন্তান হত্যার বিচারের ভার জাতির উপর ছেড়ে দেন
সরকারী এডওয়ার্ড কলেজ পাবনার ছাত্র আন্দোলনের অগ্রভাগে নেতৃত্বদানকারী ছাত্র সমন্বয়ক ও গুলিতে আহত মোঃ রাফিউল ইসলাম রাফি বলেন, পাবনায় আন্দোলনের অগ্রভাগে থাকা ছাত্র-জনতা নিরাপত্তাহীনতায় রয়েছে। তিনি এও বলেন, অনেক চিহিৃত আসামী প্রকাশ্যে ঘোরাফেরা করছে। পুলিশ তাদের ধরতে কোন কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন করছে না। প্রশাসন যদি আসামীদের গ্রেফতারে গড়িমসি করে, তাহলে প্রশাসনের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তোলার কথা জানান। তিনি অভিযোগ করে বলেন, প্রশাসন আমাদেরকে নিরপাত্তা দিচ্ছে না। আমরা অনিরাপদ ও আতংকে রয়েছি। পাবনা পুলিশ সুপারের দৃষ্টি আকর্ষন করে বলেন, দোষিদের দ্রæত গ্রেফতার করতে হবে, সেই সাথে সম্মুখ সারির যোদ্ধা, আহত বা নিহতদের পরিবারের নিরাপত্তা নিশ্চিতের দাবি জানান। তিনি মামলার বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলে অনেক আসামীই টাকা পয়সা দিয়ে এজাহার থেকে নাম প্রত্যাহার করে নিয়েছেন। তিনি প্রশ্ন রেখে বলেন, প্রথম এজাহারে ১৭৩জনের নাম উল্ল্যেখ করা হয়েছিল। পরে সংশোধিত এজাহারে ১০৩জনের নাম উল্ল্যেখ করা হয়। এর কারন বলার দরকার আছে কি। তিনি ভিডিও ফুটেজ দেখে অজ্ঞাতনামা আসামী ও তাদের ইন্ধন দাতাদের নাম এজাহারের যুক্ত করে বিচারের আওতায় আনার জোর দাবি জানান।
ভিকারুননেসা কলেজ, ঢাকার ছাত্রী পাবনায় আন্দোলনে অগ্রগামী যোদ্ধা সাদিয়া সরকার সেবা বলেন, পাবনাবাসী দেখেছে কিভাবে এমপি প্রিন্স অস্ত্রহাতে নিয়ে প্রকাশ্যে গুলি করেছে। জেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের অস্ত্র হাতে আন্দোলন দমনের ভুমিকাও সবাই জানে। দেশের এত নিছিন্দ্র নিরাপত্তা বেষ্টনি ভেদ করে হত্যা মামলার এজাহার নামীয় আসামীরা বিমান বন্দরের নিরাপত্তা চোখ ফাকি দিয়ে কিভাবে বিদেশ যেতে পারে, প্রশ্ন রাখেন। ছাত্র হত্যাকারীদের কেন গ্রেফতার করা হচ্ছে না, এটা প্রশাসনের গাফলতি না ম্যানেজ প্রক্রিয়া। গত ৪ মাস পেরিয়ে গেলে খুনি সাঈদ চেয়ারম্যান ও তার দোষরদের পুলিশ গ্রেফতার করতে পারছে না। তিনি অভিযোগ করে বলেন, পাবনার বিভিন্ন রাজনৈতিক ব্যাক্তিরা খুনিদের রক্ষা করছেন। তিনি বলেন, যদি তারা এটা করেই থাকেন, তাহলে শহীদদের রক্তের উপর পা দিয়ে এসব অপকর্ম করছেন বলে উল্ল্যেখ করেন।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার ক্রাইম এন্ড অপস মোঃ রেজিনুর রহমান জানান, ৫ আগষ্টের পরে জেলায় ৭টি মামলা হয়েছে। এ মামলায় ২৩০ জনকে আটকের কথা জানান। তবে গুরুত্বপুর্ন কোন আসামী গ্রেফতার করা না হলেও, খুব শিঘ্রই তারা ধরা পড়বে আশা প্রকাশ করেন।
পাবনার জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মফিজুল ইসলাম বলেন, নিহতদের পরিবার ও ছাত্র সম্বনয়কদের সাথে প্রতিনিয়ত যোগাযোগ রাখছেন। নিরাপত্তারহীনতার কথা কেউ তাকে অবগত করেননি। অভিযোগ পেলে সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিতের কথা জানান। প্রয়োজনে তাদের নিরাপত্তায় যৌথ বাহিনীর সহযোগিতা নেওয়া হবে।
পাবনার ছাত্র সমন্বয়ক, নিহত ও আহতদের পরিবার জানান, ৫আগষ্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে দেশ নতুন করে স্বাধীন হয়েছে। তাই তাদের দাবি নিরস্ত্র ছাত্র-জনতার উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষনকারী নির্দেশদাতা, খুনি ও তার দোষরদের চিহিৃত করে অতি দ্রুত গ্রেফতার করে কঠিন শাস্তির দাবি জানান। তারা এও বলেন, খুনিদের গ্রেফতার করা না হলে শহীদদের আত্মার সাথে বেঈমানি করা হবে। জুলাই-আগষ্ট বিপ্লবের শহীদদের খুনিদের বিচারের রায় দ্রæত কার্যকর করার মধ্যদিয়ে দেশ থেকে স্বৈরশাসকের আর্বিভাব বন্ধ হবে বলে মত প্রকাশ করেন।